ক্লাশ নাইনে পড়ি। এসেম্বলির জন্য মাঠে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। ক্লাশরুমে টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলাম। ফিজিক্যাল স্যার হন্তদন্ত হয়ে স্কুলে আসছেন। স্যারকে দেখেই দ্রুত টেবিল থেকে নামতে নামতে বলছিলাম, এই যে ফিজিক্যাল স্যার আসছেন। স্যারের পিতলের বাঁশির চেনা শব্দের অপেক্ষায় আছি। দপ্তরী এসে বললেন, আপনাকে ফিজিক্যাল স্যার ডেকেছেন। আমি সানন্দেই শিক্ষক রুমে গেলাম। মে আই কাম ইন স্যার বলে অনুমতি নিয়ে সোজা স্যারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কিরে, আমি স্কুলে ঢোকার সময় কি বলেছিলি?
স্যারের কন্ঠস্বরটা একেবারেই অচেনা মনে হলো।
কিছুই বলিনি তো স্যার!
আমাকে দেখে হাফ হাইট বলেছিলি?
[আমাদের পিটি-প্যারেডে দাঁড় করিয়ে এটেনশান, স্ট্যান্ড ইজি, লেফট রাইট-লেফট রাইট, হাফ হাইট- হাফ হাইট, রাইট টার্ন, লেফট টার্ন,এবাউট টার্ন, ফরোয়ার্ড মার্চ এইসব কমান্ড করতেন। আমরা স্যারের কন্ঠ ও বাঁশির পুরুত পুরুত শব্দের তালে তালে তা-ই করতাম। কেউ একটু ভুল করলে সাথে সাথেই সপাং করে পিঠে, নয়তো পায়ে বেত পড়তো। সবশেষে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে, জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করে ক্লাশরুমে চলে যেতাম। ৪০ মিনিটের এসেম্বলির সময়টাকে সবচেয়ে আনন্দময় একটি সময় বলে মনে হতো।]
স্যারের ধারণা, আমি পিটি-প্যারেডের ওই হাফ হাইট কমান্ড উচ্চারণ করেছিলাম।
উত্তর দিলাম, না স্যার।
দপ্তরী, জোড় বেত নিয়ে আসো।
দৌড়ে পালানোর মত সাহস ছিল না।
যা হবার তা-ই হলো। পিঠের উপড় ডাবল বেতের সপাংসপাং শব্দটা কতক্ষণ চলছিল জানীনা। এটাস্ট কমন রুম থেকে মেয়েদের উঁকি দেয়া ভয়ার্ত মুখগুলো ব্যাথা তাড়িয়ে লজ্জার চাদরে আমার পিঠটা আবৃত করে দিল। টেবিলের উপর দু’হাতে ভর করে শরীরটা যে কীভাবে স্হির হয়ে দাঁড়িয়েছিল আজও ভেবে পাই না।
এই গেলি ! স্যারের চীৎকার শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে ছুটে পালানোর আগে একবার তাকিয়ে দেখলাম স্যার হাঁপাচ্ছেন।
নিজ শ্রেণিকক্ষে ঢুকার আগেই আমার ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আমাকে টেনেহিঁচড়ে শিক্ষক রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক আগের কক্ষটাই ক্লাশ এইটের। আমার সহোদর বড় ভাই একই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তখন ওই ক্লাশে বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের পড়াচ্ছিলেন। একটা বেত নিয়ে ক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কোথায় যাচ্ছিস তোরা?
চুন্নুকে ফিজিক্যাল স্যার কেন মারলো জানতে চাই।
সেই কৈফিয়ত কি তোদেরকে দিতে হবে? বলেই বেত চালাতে আরম্ভ করলেন। সবাই ছুটাছুটি করে নিজ নিজ ক্লাশে ঢুকে পড়লো।
রক্তে ভিজে শার্টটা পিঠে লেগে চটচটে হয়ে গেছে। গোটা স্কুলে পিন পতনের নিস্তব্ধতা। কোনদিন কোন শিক্ষক তো দূরের কথা, কোন ছাত্রের সাথে খারাপ আচরণ করেছি এমন রেকর্ড নেই। তদুপরি, অ্যানুয়াল স্পোর্টস ও নাটকে চ্যাম্পিয়ন প্রাইজ, শ্রেণিকক্ষে সর্বোচ্চ উপস্হিতি, ভাল ছাত্রের সুনাম। সর্বোপরি হেড স্যারের ভাই। তাছাড়া এর আগে কোন কারণে কখনও শাস্তি পেয়েছি, এমন নজির নেই।
অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও এসেমব্লির পরিচিত সেই বাঁশিটা সেদিন বাজেনি। ক্লাশ শুরুর বেলটাতেও দপ্তরীর হাতুড়ি পেটা থমকে গেছে। কেমন একটা স্তব্ধতা স্কুলটাকে গ্রাস করে নিয়েছে। শরীরটা নিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। গায়ে জ্বর এসে গেছে। বন্ধু শাহজাহান ও জাহের আমাকে বাড়ি দিয়ে এলো।
দুপুরের পর থেকে বাড়িতে ছাত্রদের আনাগোনা বেড়ে গেল। মা কাঁচা হলুদ বেটে শরীরে মাখিয়ে দিলেন। জ্বরের তাপ কমাতে পানি ভর্তি পোড়া মাটির ছিদ্রিওয়ালা হাঁড়িতে তেনার সলতে লাগিয়ে মাথার উপড় টানিয়ে দিলেন। পিঠ ও মাথার নীচে কলা পাতা বিছিয়ে দিলেন। মাথার কাছে বসে একটানা চোখের পানি ফেলছিলেন। যেই পুতের গায়ে জীবনে একটা ফুলের টোকাও দিলাম না আইজকা তারে কেন এমন মাইরটা মারলো? কি অপরাধ করলো আমার পুতে? অনেক বড় বাড়ি আমাদের। ভাই, বোন, ভাবী, চাচীরা এসে ঘরে ভীর করে ফেললো। মায়ের কান্না শুনে আব্বা এসে ধমক দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই কোন অপরাধ করেছে; নইলে এমনে এমনেই মারে নাই। মা চুপ হয়ে গেলেন।
রাত ৮ টার দিকে ফিজিক্যাল স্যার এসে বিছানার পাশে বসে মাথায় হাত রাখলেন। চুন্নু খুব ব্যাথা পেয়েছিস? চোখ খুলে স্যারকে দেখেই ধরফর করে উঠে সোজা বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। মনে হলো আমার কিছুই হয়নি।
পরে জানতে পেরেছি, দাদা ফিজিক্যাল স্যারের কাছে গিয়ে বলেছেন, এত বড় হয়েছে আজ পর্যন্ত ওর গায়ে আমরা কেউ হাত তুলিনি। আজ এমন কি করেছে? দাদার কান্না দেখে স্যারও নাকি খুব কেঁদেছিলেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে নাকি কোন কারণে স্যারের মনটা সেদিন বিগড়ে গিয়েছিল।
প্রাইমারি স্কুলের স্যারদের মধ্যে কেউ-ই বেঁচে নেই। হাইস্কুলের স্যারদের মধ্যে আমার বড় ভাই এবং ফিজিক্যাল স্যার এখনও বেঁচে আছেন। আমরা স্যারদের নাম ধরে কখনও ডাকিনি। হেড স্যার, এসিসট্যান্ট হেড স্যার, বিএসসি স্যার, আইএসসি স্যার, বাংলা স্যার, ইংরেজি স্যার, কমার্স স্যার, হুজুর, সংস্কৃত স্যার, ফিজিক্যাল স্যার, কেরানি স্যার ইত্যাদি বলেই সম্বোধন করতাম।
গ্রামের বাড়িতে গেলে সাধারণত বিকেলে স্যারের সাথে বাজারে দেখা হয়। চাই বা না চাই মাথাটা স্যারের দিকে নুয়ে পড়ে। কী এক চৌম্বকীয় শক্তি আমার হাত দু’টো টেনে নিয়ে স্যারের পায়ে স্পর্শ করিয়ে দেয়।
কেনএমনটিহয়?
প্রায় ৪৮ বছর আগেকার সেই বেতের ভয়ে? নাকি হাফ হাইট কমান্ড শুনে শুনে স্যারের কাছে হাফ হাইটেন্ড ও হাফ হার্টেড হয়েই রইলাম? নাকি অন্য কিছু?
লেখক ময়মনসিংহের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু