কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (সদর হাসপাতাল) প্রসুতি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অজপাড়াগাঁয়ের এ হাসপাতালে প্রতিদিনই অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি ২৪ ঘন্টা প্রসব সেবা দানের বিষয়টি এলাকাবাসীর মুখে মুখে। আর একদিনে ৬টি স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও কুশলীরা। সরকারি ছুটি ব্যতিত প্রতিদিনই এলাকার জনসাধারণকে আন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগে নিয়মিত সেবা দেন হাসপাতালের চিকিৎসকগণ। আর প্রসুতি মায়েদের প্রসব সেবায় ২৪ ঘন্টাই প্রস্তুত থাকেন হাসপাতালের বিশেষ চিকিৎসা টিম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোহাম্মদ আফজালুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠিত প্রসবকালীন চিকিৎসা টিম এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে।
গত শনিবার চিকিৎসা নিতে আসা খিলা ইউনিয়নের শিকচাইল গ্রামের ইমাম হাসানের স্ত্রী আমেনা আক্তার (২৮) বলেন, এ হাসপাতালে আমার সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়েছে। এটা আমার দ্বিতীয় সিজার অপারেশন। বর্তমানে আমার মেয়ে ও আমি সুস্থ আছি। বেসরকারি হাসপাতালে গেলে ৩০/৪০ হাজার টাকা লাগতো। কিন্তু এখানে কোন টাকা-পয়সা লাগেনি। এখানকার ডাক্তার ও নার্সদের সেবায় আমরা খুব খুশি। তাদের সেবায় আমরা সন্তুষ্ট।
হাসপাতালে একইদিন স্বাভাবিক প্রসব করেন, বিপুলাসার ইউনিয়নের সাইকচাইল গ্রামের সোহেল রানার স্ত্রী নাসিমা আক্তার (২১), খিলা ইউনিয়নের সালিপুর গ্রামের মৃত আলমগীর হোসেনের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার (৩৩), মৈশাতুয়া ইউনিয়নের হাটিরপাড় গ্রামের মিহির চন্দ্রের স্ত্রী রতœা রানী (৩৫), উত্তর হাওলা ইউনিয়নের ঠেঙ্গারবাম গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী নুপুর আক্তার (২০) ও সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কন্যা সন্তান প্রসব করেন, লক্ষণপুর ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামের মিজানুর রহমানের স্ত্রী রোমানা আক্তার (২০)। মৈশাতুয়া ইউনিয়নের চিখুটিয়া গ্রামের ইসরাত জাহান মুক্তা (২১) বলেন, সোমবার রাতে আমার প্রসব বেদনা উঠলে পরিবারের লোকজন আমাকে লাকসামের বেসরকারি ক্লিনিকে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু আমার চাচা বেলাল হোসেনের পরামর্শে আমাকে মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে আমার নরমাল ডেলিভারি হয়। আমি ও আমার বাচ্চা সুস্থ আছি। হাসপাতালের ডাক্তার ও সেবিকাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। তাদের অকৃত্রিম সেবায় আমি মুগ্ধ। মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আফজালুর রহমান বলেন, এ হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫টি ডেলিভারি হয়েছে। এরমধ্যে একদিনেই ৬টি নরমাল ডেলিভারি ও ১টি সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়েছে। গর্ভবতী মায়েরা যেখান থেকেই আসুক আমাদের এখানে বিনামূল্যে এ সেবা নিতে পারবেন। এখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার উপস্থিত রয়েছেন। গাইনী এবং সার্জারি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, অন্যান্য মেডিসিন এবং অ্যানেসথেসিওলজিস্টও রয়েছেন। ২৪ ঘন্টা সার্বক্ষণিক গর্ভবতী মায়েরা এ সেবা পেতে পারেন। গর্ভবতী মায়েদের সেবায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগিদের আরো মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দিতে। আমরা আরো কিছু সুবিধা পেলে উত্তরোত্তর আরো ভালো সেবা দিতে পারবো ইনশআল্লাহ।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের এখানে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন। তিনি নিয়মিত ওয়ার্ডেও রোগি দেখছেন। কোনো ক্রিটিক্যাল রোগী আসলে ওনার সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আমাদের এখানে পয়ঃজনিং রোগিও ম্যানেজ হচ্ছে। তবে আমরা যখন দেখি সবকিছু ম্যানেজ করার পরও একটা রোগির উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন; তাহলে তাকে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এভাবে আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে সর্বাত্মকভাবে সেবা দেয়ার।
হাসপাতালে কর্তব্যরত প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ জেবুন নাহার লাভলী বলেন, মনোহরগঞ্জ উপজেলা কুমিল্লা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি। এখানে আগে যখন ডেলিভারি সেবা চালু ছিল না; তখন এখানকার মায়েরা অনেক দূর-দূরান্ত গিয়ে চিকিৎসা নিত। যা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এখন তারা হাতের কাছে বাড়ির পাশে বিনামূল্যে সার্বক্ষণিক সেবা পাচ্ছেন। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সিজারিয়ানের মাধ্যমে ডেলিভারি করিয়ে থাকি। যা মায়ের জন্য জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া। প্রতিমাসে এখানে ২৫/৩০টা নরমাল ডেলিভারি এবং ৫/৬টা সিজারিয়ান হচ্ছে। আমাদের প্রসব সেবা নিয়োজিত বিশেষ টিম অত্যন্ত আন্তরিক ও পেশাদারি মনোভাব নিয়ে সেবা দিয়ে থাকেন। অনেকে সরকারি হাসপাতালের সেবা নিয়ে কথা তোলেন। আমি তাদের বলবো আমাদের এখানে আসেন। আগে সেবা নেন। পরে মন্তব্য করবেন। শুধু শুনে শুনেই মন্তব্য করবেন না। এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজে সার্বক্ষণিক এ বিশেষ টিমসহ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার তদারক করেন। তিনি নিজে এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তদারকির পাশাপাশি সবসময় খোঁজ-খবর নিচ্ছেন যাতে আমরা রোগিদের প্রতি আরো আন্তরিক হই। স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার জন্য রোগিদের মাঝে প্রচারণার জন্য তাগিদ দেন।
মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহমুদা মুনমুন বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় আমাদের এখানে স্বাস্থ্য সেবা অনেক উন্নত। প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে অনেকে জানেনা, বুঝেনা। কিন্তু যারে আসেন তারা বিনামূল্যে উন্নত সেবা পাচ্ছেন। আবার তারাই এলাকায় গিয়ে এ হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নেয়ার জন্য অন্যান্য রোগিদের নিকট প্রচার করছেন। এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, আমাদেরও কিছুটা সিমাবদ্ধতা আছে। আমরা কিছু কিছু রোগিকে সেবা দিতে পারি না। সেক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাদের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সেবার মাধ্যমে রোগিকে জেলা সদরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। যখন কোন মা কনসেপ্ট করে তখন থেকে ফ্রি অ্যাম্বুলেন্সসহ হাসপাতাল থেকে আয়রন, ক্যালসিয়ামসহ সকল চিকিৎসা ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটা রোগির ফোন নাম্বার আমরা সংগ্রহে রাখি। কোন রোগির অসুবিধা হচ্ছে কিনা, তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দরকার প্রয়োজন আছে কিনা। সেক্ষেত্রে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সস