শফিকুল ইসলাম।
১৯৭১সাল,নুরির বয়স ১৭ দাদু আদর করে সুন্দরী বলে ডাকতো। একদিন সন্ধায় পাশের গ্রামের কয়েকজন বাবার বয়সি পূরুষ মানুষ আসলো নুরিদের বাড়িতে একজনের হাতে লালচিনি ভর্তি একটা মাটির পাত্র।দাদু বললো নুরি লো কই এইহানে আয়
বুড়ি সইন্ধ্যে বেলায় ডাহো কেড়ে? এহনই কিচ্ছা কইবানি?
নুরিকে প্রতিরাতে দাদু কিচ্ছা শোনাতো, কমলা সুন্দরী,সয়ফর মুল্লুক, আরো কতো কিচ্ছা। না, আজ দাদুর কাছে যেতেই নুরি দেখলো হাতে কাঠের চিরুনি মাটির পেয়ালাভর্তি সরিষার তেল, সুরমাদানি। দাদু নুরির দিকে থাকিয়ে হাসছে। নুরির মাথায় তেল দিতে দিতে দাদু বললো কিছু দিনের মইধ্যে কমলা সুন্দরীরে নেওয়ার লাইগ্যা একজন রাজপুত্তর আইবো।
বুন্নি অবেলায় মাথায় তেল দেও কেড়ে? ঘরের অন্য কোঠা থেকে আওয়াজ আসছে কই তাড়াতাড়ি কইরো।
নুরি কিছুই বুঝেনা কি হতে যাচ্ছে। নুরিকে সাজিয়ে কিছু অপরিচিত মানুষের সামনে আনা হলো।
সাথে দাদু নুরির পিঠে চিমটি কেটে আস্তে বলে সালাম দে।
আসসালামু আলাইকুম।
-তোমার নাম কি?
-নুরি।
-কায়দা পড়ছো ?
-আমপারা লইছি।
-একটা সুরা কওতো?
নুরি সুরা পরার মধ্যেই একজন বলে উঠলো মাশাআল্লাহ আমরার পছন্দ হইছে, জৈষ্ঠ মাসের পয়লা সপ্তার বুধবারে তুইল্যা নিমু।তিন আনা পয়সা নুরির হাতে দিয়া বলে যাও মা।
পরের দিন নুরিকে পাড়ার বান্ধবীরা বলে, -কিলো নুরি তোর নাহি বিয়া অইবো?
-অয় জৈষ্ঠ মাসে।
নুরি স্বপ্ন বুনে! স্বপ্ন দেখে মাঝেমধ্যে লাজুক ভঙ্গিতে কি যেন ভাবে! হয়তো বরের কথা বরের সাথে নিজের কথা বরের সাথে কেমনে কথা বলবে এ নিয়ে কল্পনার রাজ্যে বীজ বোনে নুরি।
দাদু রাত্রে আর কিচ্ছা বলেনা। নতুন বরের সাথে কিভাবে কি করতে হয়,,,,,, নুরির শরম লাগে
বেশরমা বুন্নি,,,,,,,,,,, তোমার সাথে থাহুমনা।
অহনই! ছাইরা দিবে? দামান আইবো জৈষ্ঠ মাসে, বুন্নিরে আর ভালা লাগেনা!
এপ্রিলের শেষ ভাগে গ্রামের বটতলীতে লোকজন বলাবলি করছে শহরে গন্ডগোল ( যুদ্ধ) নাকি গ্রামের মাঝেও আসবে। গন্ডগোল মানে পাকিস্থানী হায়েনাদের হত্যাকান্ডের তান্ডব। প্রতিদিন স্কুলের মাষ্টার গফুর মিয়ার বাড়ির আঙিনায় গ্রামের মানুষ রেডিও শোনে কি যেন বলাবলি করে নুরিব বাবাও প্রতিদিন রেডিও শোনে।
নুরির মায়ের সাথে এনিয়ে কথা বলে নুরির পিতা।
গেরামেও আইবো?
হ এমনইতো কইতাছে, মাষ্টর কাকাও তো কইলো সাবধানে থাহার জন্য।
নুরির বিয়ার বেপারে কি চিন্তা করছো? গরু দুইডা বেইচা দিবা? বাজানে কইছে পঞ্চাশ টেহা দিবো নুরির বিয়ার সময়।
গরু দুইডা বেইচা দিলে হালচাষ করমু কেমনে।
মহাজন ধইরা দুইশো টেহা লগ্নি লইমুনে। এইতা নিয়া চিন্তা কইরোনা, আল্লাহ ভরসা।
গ্রামের রমিজ মোল্লার কথাবার্তায় কেমন জানি ভয় ভয় লাগে।কি শান্তি কমিটির কথা বলে, রাজাকারে যাইতে হবে, মাষ্টরের কছে গ্রামবাসীকে যাইতে নিষেধ করে।
নুরির বাবার কাছে রমিজ মোল্লার কথাবার্তা ভালো লাগেনা। মাষ্টার সাহেব অনেক সুন্দর কথা বলে। মাষ্টার সাহেবের কথা শোনলে কেন জানি ভালো লাগে, দেশের কথা বলে, মুক্তির কথা বলে, অধিকারের কথা বলে বাড়িতে রেডিও শোনতে গেলে মাষ্টর চাচি সাবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ায়। কিন্তু রমিজ মোল্লা সারাদিন পান চিবায় গড়গড় করে হুক্কায় তামাক টানে আর সুদের খাতায় হিসাব করে।
নুরির বাবা যদিও রমিজ মোল্লাকে ভালো পায়না, তার পরও যেতে হবে নুরির বিয়ের জন্য সুদে টাকা আনার জন্য।
-কিরে জব্বইরা কিয়ের লাগি আইছস?
-চাচাজি,,,,,,,,,,,,
-টেহা লাগবো,,,,, কতো?
-জ্বি -দুইশো।
-জমির দলিল আনছস।
-জ্বি।
-অত্তো টেহা দিয়া কি করবে?
-চাচাজি মায়াডারে বিয়া দিতে অইবো।জৈষ্টমাসে বিয়া।
-আগামীতে তিনশো দিয়া দিমুনে, এই দলিল।
-একটু তামাক ভইরা দে তো। তোর মাইয়াডা তো মাশাআল্লাহ বেশ ডাঙর, দেখতে তো,,,,,,,,,,??????।
কামাতুর চোখে রমিজ মোল্লা কি যেন ভাবে। নুরির বাবা কলকিতে তামাক দিতে দিতে রমিজ মোল্লার দিকে থাকায়,রমিজ মোল্লার চেহারাটা কেমন জানি ভয়ানক মনে হয়।
ফর্সি হুক্কায় তামাক টানতে টানতে,,,,, -নুরির বিয়া দিবার লাগি টেহা নিতে আইছস, ত মাষ্টরের বাড়িতে গিয়া কি করস?
মাষ্টর তো আওয়ামিলীগ করে হে দেশ স্বাধিনের কথা কয়।মাষ্টরের বাড়িতে যাবিনা। গেরামে শান্তি কমিটি করমু তুই শান্তি কমিটিতে থাকবি?
-চাচা আমরা গরিব মানুষ অশিক্ষিত,আমরারে দিয়া কি করবাইন।
-কথা কস কেন্ তোর শান্তিকমিটিতে যাওন লাগবো।
-না চাচা আমি যাইমুনা।
-যাইবিনা! ত আমার কাছে টেহার লাগি আইছস ক্যা?
যা তোর মাষ্টর বাপেরে গিয়া ক টেহা দিবনে।
আমি তোরে টেহা দিমুনা যা আমার সামনে থাইক্যা।
-চাচা মাইয়াডার বিয়া একটু দয়া করইন।
-যা কইতাছি বেজন্মা কোহানের।
রাতে নুরির বাবার ঘুম আসেনা, কি করবে সকালে মাষ্টরের কাছে যাবে? নাকি রমিজ মোল্লার কাছে গিয়ে শান্তিকমিটিতে নাম লেখাবে?
কিগো তিমি ঘুমাওনা কেরে?
নুরির মা রমিজ চাচা টেহা দেয় নাই।শান্তিকমিটিতে নাম লেহাইবার কথা কয়।মাষ্টর কাকারে গালাগালি করে।
না তুমি রমিজ মোল্লার কথা শোইন্যোনা হে খারাপ মানুষ নামাজও পড়ে সুদও খায় তিনডা চাইট্টা বিয়া করছে একটা বৌয়েরেতো পিডাইয়া মাইরাই ফেললো।
বিয়ানে মাষ্টর কাকার বাড়িতে যাও,নুরির বিয়ার বিষয়ে কথা কও।
আইচ্ছা অহন ঘুমা।
পরদিন সকালে নুরির বাবা গফুর মাষ্টরের বাড়িতে যায়।
-কি জব্বার এতো সকালে কি মনে করে ?
-কাকা জৈষ্টমাসে নুরির বিয়া, জামাইরে একটা সাইকেল আর একটা রেডিও দেওন লাগবো দুইশো টেহা লাগে।
-বাবারে আজ এক বছর ধরে কোন মাইনে পাইনা, খুব কষ্টে আছি, ছেলেটারে শহরের কলেজে পাঠালাম, কোন খোঁজ খবর পাইতেছিনা।
-কাকা জমির দলিল নিয়া আইছি।
-জব্বর তুমি আমারে সুদখোর ভাবছো!?
-কাকা আমার ভূল হইছে, নুরির বিয়া কেমনে কি করমু আমি কই যামু।
-বাবারে তোমারে টাকা দিতে দলিল লাগবোনা।আচ্ছা তুমি বস দেখি তোমার চাচিরে বইলা।
কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে মাষ্টার সাহেব হাতে একটি স্বর্ণের বালা নিয়ে নুরির বাবার হাতে দিয়ে বলে, বাবা ঘরে নগদ টাকা পয়সা নাই, তোমার চাচীকে দুইটা বালা দিয়েছিলাম, এর একটা তোমাকে দিলাম, এই নেও এইডা বিক্রি করে কাজ চালাও।
নুরির বাবার কেন জানি অজানা ভালো লাগায় চোখ থেকে পানি ঝড়ছে মনে মনে ভাবে ওরা কি মানুষ না ফেরেস্তা।
-শোনো জব্বার তোমার যখন সময় ভাল হয় তখন এইটার মূল্যের টাকা দিয়া দিও, আগে তোমার মাইয়ার বিয়ার কাজ শেষ করো।
-আচ্ছা কাকা, আমার মাইয়ার বিয়াতে আফনেরা দুইজন যাইবেন।
অবশ্যই।
নুরির বাবা স্বর্ণের বালাটি নিয়ে গঞ্জে গেছে বিক্রি করে সাইকেল আর রেডিও কিনতে, কিন্তুু সন্ধা পেরিয়ে রাত নেমে এলো এখনো বাড়িতে ফিরেনা।
পরদিন সারাদি গেলো কোন খবর নেই। এর মধ্যে শহর থেকে পাকিস্থানী সেনারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো, গভির রাত নুরির মা স্বামী না ফেরায় কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ গ্রামে আর্ত চিৎকার গুলির শব্দ পাশের গ্রামে আগুন।
নুরি ও নুরি উঠ তাড়াতাড়ি কর গেরামে মেলিটারী আইছে আল্লাগো,,,,,, তোর বাপতো এহনো আইলোনা কি করমু আমরা?
গভীর রাতে নুরিদের বাড়িতে পাকিস্থানী হায়েনাদের হানা। নুরিদের দরজায় লাথি দিয়ে দরজার কপাট দুইখান ভেঙে ফেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে পাকিস্থানী হায়েনারা।
খুব সুরত আদমি হ্যায়,,,,, লিয়ে চলো
-বাবারা আপনাদের আল্লার দোহায় আমার মাইয়াডারে নিয়েন না।
একটা গুলির শব্দ! নুরির সামনে নুরির মা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। নুরিদের ঘরটায় পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো ,নুরির দাদু ঘরের ভিতরেই আটকা পরে। নুরি কে টেনে হিছড়ে নিয়ে গোলো সেনা ক্যাম্পে।
পরদিন সকালে দশ বারোজন পাকিস্থানী সেনা পালাক্রমে ধর্ষণ করে নুরিকে, ও আল্লাগো আর পারিনা আমারে ছাইড়া দ্যান।
এক নারকীয় পৈশাচীক উল্লাসে মেতে উঠলো পাকিস্থানী ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
রমিজ মোল্লা পাকিস্থানী অফিসার কে বলে
-জনাব আমি একটু,,,,,,,,,,,,
-সালা বাঙাল মুছলমান আছে সালা টুপি খোলে লে।
-দাদা আপনার পায়ে পড়ি আমারে আর,,,, , আমি মইরা যাইমু, আমারে মাইরা ফালান, ও,,,, মাগো ও আল্লারে উফ ।
নুরি ছেছড়িয়ে ছেছড়িয়ে একটি অন্ধকার কক্ষ থেকে বারান্দায় আসলো পক্ষ থেকে বারান্দা অবধি নারীর রক্তের প্রলেপে লেপটে গেল, পড়নের সবুজ ডোরা কাটা শাড়িটা রক্তে ছপ ছপ করছে জরায়ু
দিয়ে রক্তের স্রোত, বুকের দিকটা পিশাচরা থেঁতলে দিয়েছে। তারপর এক পাকিস্থানী হায়েনা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নুরির দেহটা ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করলো। সেদিন ছিল জৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহের মঙ্গলবার।
বায়ান্ন বছর পর আমি আবার নুরির আর্তনাদ শোনতে পাচ্ছি নুরির আত্মা বাংলাদেশের মানুষ কে বলছে হে আমার ভাইয়েরা হে তরুণ আমি তোমাদের নুরি আজ থেকে বায়ান্ন বছর পূর্বে একটি পরাধীন দেশে আমার জন্ম হয়েছিলো। তোমার ঘরে সতোরো বছরের যে কন্যাটি আছে, আমিও সে রকম একজন পিতার শতেরো বছরের আদরের কন্যা ছিলাম, হে তরুণগন তোমাদের যে আদরের বোনটি এখন তোমাদের ঘরটিকে আলোকিত করে রাখে ঠিক বায়ান্ন বছর আগে আমিও তোমাদের একজন বোন ছিলাম। আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো অনেক স্বপ্ন বুনেছিলাম, কিন্তু পাকিস্থানী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরেরা আমাকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। আমার পরনের শাড়িটা রক্তে রন্জিত করেছে তারা। আমার শাড়িটা আজ তোমাদের জন্য পতাকা করে দিয়ে গিয়েছিলাম। তোমাদের বোনের, তোমাদের কন্যার পবিত্র রক্ত দিয়ে নির্মিত পতাকাটি কখনই অপবিত্র করোনা।এখনো পাকিস্থানীদের দোসরেরা বাংলাদেশে রয়ে গেছে, বিষাক্ত হোল এখনো ফুটাতে চায় তারা। বহুদলীয় গনতান্রের নামে তাদেরকে এদেশে আনা হয়েছে। তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই পাকিস্থানী দোসরদের গাড়িতে আমার রক্তেমাখা শাড়িটা উড়াতে দিওনা। যদি তা করো তাহলে তাহলে তোমার আদরের বোনটিকেও তারা ধর্ষণ করবে তোমাদের ঘর আলোকিত করা কন্যাটি ধর্ষিত হবে, যেমন ধর্ষিত হয়েছে আমার বোন পূর্ণিমা, ইয়াসমিনেরা। এটা আমার অভিশাপ নয় আমার যন্রণাকাতর অভিজ্ঞা।
তোমার রক্তে কেনা পবিত্র দেশকে কলংকিত করোনা, আল্লাহ সইবেনা। এই বিজয়ের মাসে আমার কবরের উপর দাড়িয়ে তোমরা আমাকে আমার পবিত্র রক্তেভেজা পতাকার অবমাননা করোনা। তোমরা তো আমার ভাই, আমার পিতা, আমার মা, আমার বোন।
আমাকে যারা চিরে চিরে খেয়েছে, তারা কিভাবে তোমাদের মঙ্গল করবে? একজন মুক্তিযোদ্ধা সারা জীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারেনা, অনেক মুক্তিযোদ্ধারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে আমার কবরের উপর দাড়িয়ে দেশের সাথে আমার ত্যাগের সাথে ত্রিশ লক্ষ শহিদের সাথে বেইমানি করেছে, পাকিস্থানী দোসরদের সাথে আপস করেছে মন্রী তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে। তাদেরকে ক্ষমা করবানা। বাবা আমি তোমার মেয়ে, যার রক্তে বাংলার পতাকা, ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে আকাশে উড়ানো পতাকটির দিকে থাকিয়ে থেকো আমাকে দেখতে পাবে।
ইতি :
তোমাদের নুরি।